অস্ত্রের মুখে যেভাবে দখল হয় ইসলামী ব্যাংক

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িতদের জন্য ইসলামী ব্যাংক ছিল লোভনীয় টার্গেট। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালে যখন শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী জোর করে দখলে নেয় তখন আমানতের দিক থেকে শীর্ষে ছিল এটি। এই ঘটনা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে ‘ডাকাতি’র ‌একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি সকালে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) কয়েকজন সদস্য ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বাসা থেকে তুলে এনে একে একে এজেন্সির প্রধান দপ্তরে হাজির করে।

তাদেরকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পরে, ঢাকার একটি হোটেলে সামরিক কর্মকর্তাদের নজরদারির মধ্যে ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ করা হয়।

এই ঘটনার সাত বছর পর এস আলম গ্রুপের ইসলামী ব্যাংক দখল নিয়ে নীরবতা ভাঙলেন ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে যা ছিল ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে নেতিবাচক ঘটনাগুলোর অন্যতম।

‘এটা খুবই হতাশাজনক যে একটি সরকারি নিরাপত্তা সংস্থাকে একটি বেসরকারি গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এর সঙ্গে জড়িত ছিল বলে মনে করছি,’ গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন আবদুল মান্নান।

তিনি বলেন, ‘আমাকে ডিজিএফআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আকবর হোসেনের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি প্রথমে আমার প্রশংসা করেন, অর্থনীতি সম্পর্কে আমার পরামর্শ চান আর তারপরই আমাকে পদত্যাগ করতে বলেন।’

পদত্যাগ না করার কথা ভদ্রভাবে আমি তাকে জানাই, বলেন আব্দুল মান্নান।

মান্নান বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে আমার একটা আবেগের সম্পর্ক রয়েছে এবং পদত্যাগ করা আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। আমি ব্যাংকের প্রথম দিন থেকেই এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম। বিশ্বের কোনো প্রতিষ্ঠানের এমডিকে এমন চাপের মুখোমুখি হতে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।’

মান্নানের কাছে ডিজিএফআই অফিস ‘নরকের মতো’ মনে হয়েছিল।

তিনি যখন বলেন যে তার জন্য পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন, তখন ডিজিএফআই প্রধান বলেছিলেন ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ চায় আবদুল মান্নান যেন ব্যাংক ছেড়ে চলে যান।

‘ডিজিএফআই অফিসের ভেতরে আমার এত খারাপ লাগছিল যে তারা কয়েকবার আমার রক্তচাপ মাপেন।’

২০১০ সাল থেকে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা আব্দুল মান্নান অভিযোগ করে বলেন, জিম্মি করে তাকে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা তাদের অফিসে অবস্থান করছিলেন। আর সবটাই হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবিরের নজরদারিতে।

১৯৮৩ সালে গঠিত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটির মালিকানা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় ২০০৬ সালে, যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের ৩২টি চেকবই পাওয়া যায়। সে সময় গণমাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

তথ্য ও পরিসংখ্যান ছাড়াই ইসলামী ব্যাংককে সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত করে অনেক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বলছিলেন একসময় ব্যাংকটির মুখপাত্র আবদুল মান্নান।

২০১১ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু অভিযোগ করেন, ইসলামী ব্যাংক মুনাফার ৮ শতাংশ সন্ত্রাসে অর্থায়নে ব্যয় করেছে। এতে ব্যাংকটির আরও এক দফা সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।

‘এটি ছিল একজন অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য এবং আমি মনে করি এই মন্তব্যের জন্য সরকারের তাকে বরখাস্ত করা উচিত ছিল।’

এম এ মান্নান বলেন, ‘মন্ত্রী তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং আমি তার বাসায় গেলে তিনি আমাকে বলেন, এটা তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।’

কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।

টুকুর এই অভিযোগ বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবাদাতা ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন সক্ষমতাকে ‘মারাত্মকভাবে প্রভাবিত’ করে।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ফাঁসির দাবিতে ২০১৩ সালে শাহবাগে আন্দোলনকারীরা আন্দোলন করলে ব্যাংকটির ওপর চাপ আবার তীব্র হয়।

বিক্ষোভ চলার মধ্যেই একজন অর্থনীতিবিদ অভিযোগ করেন, সন্ত্রাসে অর্থায়নের জন্য ব্যাংকটি থেকে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে।

তারা সবাই ইসলামী ব্যাংককে জামায়াতে ইসলামীর ব্যাংক হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং এর অধিগ্রহণের কথা ছড়িয়ে পড়ে,’ বলেন মান্নান।

আব্দুল মান্নান বলেন, প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকটির ৭০ শতাংশ শেয়ার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ (আইডিবি) বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ছিল, ১৫ শতাংশ স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের হাতে, ৫ শতাংশ সরকারের হাতে এবং ১০ শতাংশ ছিল শেয়ার বাজারে।

তিনি বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আতিউর রহমান ব্যাংকটিকে অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন।

‘এটি আমাদের জন্য একটা বড় সহায়তা ছিল,’ তিনি যোগ করেন।

২০১৬ সালে ব্যাংকটির মালিকানা আরও খারাপের দিকে যেতে শুরু করে যখন বিভিন্ন গোষ্ঠী ব্যাংকটি বন্ধ করে দেওয়া বা এটি অধিগ্রহণের জন্য সরকারের উপর চাপ তৈরি করে।

সরকারের নির্দেশে ব্যাংকটিতে চারজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে ব্যাংকটি দ্রুত অধিগ্রহণ করা হচ্ছে।

চার স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন- ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী ও ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আজিজুল হক।

ইসলামী ব্যাংকের এস আলম গ্রুপের ‘পেছনের দরজা দিয়ে’ এসে দখল করার প্রাথমিক পর্যায়। যা থেকে সতর্ক হতে শুরু করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

লন্ডনভিত্তিক ইকোনোমিস্ট ম্যাগাজিন ২০১৭ সালে এক প্রতিবেদনে জানায় বোর্ডরুম ক্যু’র বিষয়ে সৌদি আরব ও কুয়েতের শেয়ারহোল্ডারদের কিছুই জানানো হয়নি এবং এ নিয়ে তারা অভিযোগ জানিয়েছিলেন।

তাদের মধ্যে একটি ছিল জেদ্দা ভিত্তিক আইডিবি। তারা বলছে ২০১৭ এর জানুয়ারিতে মাত্র তিন দিনের নোটিশে বোর্ড মিটিং ডাকা হয়, যে কারণে তারা কাউকে পাঠাতে পারেনি। পরে আইডিবি ইসলামী ব্যাংকের সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়।

ওই মাসেই ক্ষমতা দখলের কাজ শেষ হলে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী আমলা হিসেবে বিবেচিত আরাস্তু খানকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এক বছরের কিছু বেশি সময় তিনি কাজ করতে পেরেছিলেন। তার আকস্মিক প্রস্থান অন্যান্য পরিচালক এবং কর্মচারীদের হতবাক করেছিল, একজন পরিচালক জানিয়েছিলেন যে আরও পরিবর্তন আসছে।

এস আলমের ‘বোর্ডরুম ক্যু’র আগে বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকিং সম্পদের এক-তৃতীয়াংশই ছিল এই ব্যাংকটির কাছে। ১০ বিলিয়ন ডলারের ব্যালেন্স শিট থাকা এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমেই বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের এক চতুর্থাংশেরও বেশি আসত। আর এ সবই এস আলমকে এই ব্যাংকের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

ইসলামী ব্যাংকে বিপুল সংখ্যক শেয়ার কিনতে চট্টগ্রামভিত্তিক এ গ্রুপটি নিজেদের লোক মাঠে নামায়।

‘আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে এস আলম গ্রুপ বেসরকারি খাতের বৃহত্তম ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চলেছে। এর আগে ইসলামী ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনছে যেসব কোম্পানি, সেগুলো আমাদের পরিচিত ছিল না,’ বলেন মান্নান।

২০১৬ সাল থেকে ব্যাংকটির শ্রেণিকৃত ঋণ ১৯৩ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। পুঁজিবাজারে সবচেয়ে সম্পদশালী কোম্পানি হিসেবেও শীর্ষস্থান হারিয়েছে এটি।

ব্যাংকের নথি অনুসারে, পরিচালনা পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর মোহাম্মদ সাইফুল আলমের মালিকানাধীন চট্টগ্রামভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক থেকে ৭৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়, যা চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের মোট বকেয়া ঋণের ৪৭ শতাংশ।

শেয়ার করুন:-

বিজ্ঞাপন

সম্পর্কিত খবর