গত ১৫ বছরে দেশের পুঁজিবাজার জুয়াড়িদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিলো। শিবলী কমিশন সবেচেয়ে বেশি জুয়াড়িদের প্রমোট করেছেন। এর ফলে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীবান্ধব না হয়ে জুয়াড়িবান্ধব হয়েছে। ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে এ কথা বলেছেন। সাক্ষাতকারে তিনি পুঁজিবাজার ও অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন।
সাংবাদিক: ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের পুঁজিবাজারে আশানুরুপ উন্নতি হয়নি। কিভাবে এই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জাতি অন্ধকার থেকে আলোতে এসেছে। সামনের দিনগুলোতে দুর্নীতি, অর্থ লোপাট, পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম থাকবে না। ভবিষ্যতে যা হবে তা সবাই দেখতে পাবে, অর্থাৎ গোপনে আর কিছু হবে না।গুলোকে
গত ১০ বছরে পুঁজিবাজারে উন্নতি হওয়ার পরিবর্তে আরও অবনতি হয়েছে। পুঁজিবাজারের আকার ছোট হয়ে জিডিপিতেও অবদান কমে গেছে। আগে জিডিপিতে অবদান ছিলো ২৫ শতাংশের উপরে, যা এখন ১১ শতাংশে নিচে নেমে এসেছে। তারপরে কতগুলো অখাদ্য কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। জেড ক্যাটাগরির অর্থাৎ ওটিসি মার্কেট থেকে যেগুলো চলবে না, সেগুলোকে এসএমই বোর্ডে জুয়া খেলার জন্য দিয়েছে শিবলী কমিশন। শেষ পর্যন্ত সেগুলোর মধ্যে দুএকটা ছাড়া বাকি সব কোম্পানি ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যর্থ কোম্পানি ১০ শতাংশ পর্যন্তও লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
অর্থাৎ পুঁজিবাজারে নতুন কিছু না এনে ব্যর্থ কোম্পানিগুলোকে জুয়াড়িদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারী নির্ভর না হয়ে জুয়াড়ি নির্ভর একটি শেয়ারবাজার গড়ে তোলা হয়েছে। এরপর প্রায় দুই বছর ফ্লোর প্রাইস দিয়ে রেখেছিলো। পৃথিবীর কোথাও ফ্লোর প্রাইস বলতে কিছু নেই। ফ্লোরপ্রাইস দেওয়ার কারণে প্রাইস ডিসকোভারি করা সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন ৮০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার বেচা-কেনা হতো না।
ফ্লোর প্রাইসের কারণে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশও (আইসিবি) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আইসিবি ধার করে ফান্ড নিয়ে এসেছে। আইসিবি শেয়ার কিনে আটকা পড়ে গেছে। সঠিক সময়ে ধার করা টাকা শোধ করতে না পেরে আইসিবি অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এই ফ্লোর প্রাইসের কারণে অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এখন নতুন সরকার, একইসঙ্গে নতুন পলিসি। এখন আর আইসিবিকে দিয়ে জোর করে শেয়ার কেনানো যাবে না। আইসিবি থেকে ব্যবসাগুলো নিয়ে গেছে। দুটো মিউচুয়াল ফান্ডের ট্রাস্টি দিয়ে দিয়েছে বিজিআইসি ও সন্ধানীকে। আইসিবি থেকে ভালো ট্রাস্টি এরা কিভাবে হতে পারে?
বিএসইসি আরেকটি নিয়ম করেছিলো, ৫ শতাংশের উপরে কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনা যাবে না। তাহলে আইসিবি যদি ৫ শতাংশের উপরে ভালো কোম্পানির শেয়ার না কিনতে পারে। তাহলে খারাপ শেয়ার কিনতে হবে। এভাবে এখন আইসিবির পোর্টফোলিওতে জাঙ্ক শেয়ারের ছড়াছড়ি। ওগুলো থেকে আইসিবি ভালো কিছু পাবে না। আরও দুর্ভাগ্য হলো- আইসিবি ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা দিয়ে রেখেছিলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে, যারা বেশি সুদ দিতো। লিজিং কোম্পানিগুলোর এখন ব্যবসা নেই, ইতিমধ্যো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড টাকা নিয়ে ভেগেছে। এভাবে আইসিবি নিজের টাকা হারিয়ে এখন তারল্য সংকটে ভুগছে।
সাংবাদিক: ব্যাংক খাতের চলমান তারল্য সংকটের প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়বে কিনা?
তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো ২০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনার কথা ছিলো। তবে তারল্য সংকটের কারণে কিনতে পারে নাই। ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের কারনে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অবশ্য ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা আশা করছি সামনের দিনগুলোতে আর এভাবে লোপাট হবে না। ইসলামী ব্যাংক সহ এ খাত ভালোর দিকে যাবে। লোপাট হওয়া অর্থ দেশের বাইরে চলে গেছে। এটাই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।
আস্থা সংকটের কারণে পুঁজিবাজারও তারল্য সংকটে ভুগছে। পুঁজিবাজারে এখন যে নিম্নমুখী অবস্থা তার অন্যতম কারণ বিশ্বব্যাপী সুদের হার বেড়ে যাওয়া, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটের প্রভাব। পুঁজিবাজার থেকে লোপাট হওয়া অর্থও দেশের বাইরে চলে গেছে। শেয়ার কারসাজি করে একেকটা কোম্পানির শেয়ার দর যেখানে উঠানো হয়েছিলো তা অনেক নিচে নেমে এসেছে।
খুলনা পেপারের শেয়ার দর ৬০ টাকায় উঠেছিলো, তা এখন ১৩-১৪ টাকায় নেমে এসেছে। তারপর শাইনপুকুর সিরামিকসের দাম উঠানো হয়েছে ৫২ টকাার উপরে, তা এখন ১৭ টাকায় নেমে এসেছে। এভাবে শেয়ার কারসাজি করে অনেক কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ানো হয়েছে। কারসাজির মাধ্যমে অনেকে অনেক টাকা নিয়ে গেছে। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হয়েছে।
সাংবাদিক: বিগত দিনে পুঁজিবাজারে নানা অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলো তাদেরকে আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে তাদেরকে শাস্তি দিতে না পারলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবে কিনা?
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শেয়ার কারসাজিকারীদের প্রমোট করেছিলো। আর এক্ষেত্রে শিবলী কমিশনের সহযোগিতা ছিলো। তবে নতুন কমিশন আসার পর শেয়ার কারসাজিদের কিছু অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে। কারসাজি করে এখন আর কেউ পার পাবে না। প্রথম থেকে যদি কমিশন কঠোর অবস্থানে থাকতো তাহলে কারসাজির কোনো সুযোগ ছিলো না। আমি সবসময় বলি, জুয়াড়ি ভাড়া করে শেয়ারবাজার ভালো করা যায় না। এটা সয়তো সাময়িক সমাধান দিতে পারে। শেয়ারবাজারে আসল ফান্ড হলো যারা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে যায় তারা।
পুঁজিবাজারে নতুন কিছু আসে নাই। বন্ড মার্কেটের কথা অনেক বলা হয়েছে, তবে কয়টা বন্ড ট্রেড হয়েছে? একটা সুকুক এসে শুরুতে ১০০ টাকায় লেনদেন হচ্ছিলো, পরবর্তীতে দেখলাম সেটি ৪৫ টাকায় নেমে এসেছে। এরপর হয়তো আরও কিছুটা বেড়েছে। এখানেও আস্থার সংকট রয়েছে। তবে আমি আশাবাদী এইজন্য, এই সরকারকে সবাই টাকা পয়সা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক সহ আরো অনেকে টাকা দিচ্ছে। আগামী এক মাসের মধ্যে রিজার্ভ আরো বেড়ে যাবে। তখন ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার মূল্য স্থিতিশীল হয়ে যাবে। তখন আমাদের দ্রব্যমূল্যও কমবে। পাশাপাশি তখন আস্থা ফিরে আসবে। এই সরকার যদি অর্থনীতি ভালো করতে না পারে তাহলে অন্য কেউ পারবে না। সুতরাং এই সরকারকে সময় দিতে হবে এবং সবার সহযোগিতাও দরকার আছে।
সাংবাদিক: বিএসইসির নতুন কমিশন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন কাজগুলো করলে পুঁজিবাজারের জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে আপনি মনে করেন?
নতুন কমিশনের কাজ হলো ট্রান্সপারেন্সি, কারসাজি যারা করে তাদের ধরা এবং ভালো আইপিও আনা। সেটা হয়তো বিএসইসি নিজেরা একা করতে পারবে না। এজন্য উচিত সরকারের সঙ্গে বসা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে বছরে দুটি ভালো আইপিও আনতে পারলেও যথেষ্ট। কারণ আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বছরে ২৫টি আইপিও চায় না। ভালো দুই-তিনটা আইপিও হলেই তারা খুশি।
তবে গত ১০ থেকে ১৫ বছরে যত হাই-প্রিমিয়ামে যেসব আইপিও এসেছে সেগুলোর দাম এখন অর্ধেক। সেসব কোম্পানি সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিচ্ছে। তবে তারা প্রিমিয়ামে টাকা নিয়েছে।
সাংবাদিক: ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। একইভাবে পুঁজিবাজার সংস্কারের জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় বলে কি আপনি মনে করেন?
ব্যাংক খাতের মতো পুঁজিবাজারেও টাস্কফোর্স হওয়া উচিত ছিলো। এখানে না হলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এখনই সরকারি শেয়ারগুলো বিক্রি করার সময়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সময়ে শেয়ারগুলো বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। আমার কাছে মনে হয় এখন আর কেউ বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারি শেয়ারগুলো বিক্রি করলে দুটো উপকার হবে- সরকার টাকা ধার করা থেকে বাচবে, দ্বিতীয়ত অধিকাংশ শেয়ার অফলোড করলে যদি নতুন ম্যানেজমেন্ট আসে তাহলে সম্পদগুলো এক্টিভিটেড হবে।
সরকারি শেয়ার রয়েছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের কোনো আয় নেই। উলটো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ভর্তুকি দিয়ে চলতেছে। যখন এসব প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হয়েছিলো তখন এগুলোর আয় ছিলো। এসব কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করলে ম্যানেজমেন্টে আসার জন্য কেউ না কেউ কিনবে। এসব কোম্পানির মেশিনারিজ, জমি ও বিল্ডিং সহ আরও অনেক সম্পদ রয়েছে। এজন্য শেয়ার কিনে ম্যানেজমেন্টে গিয়ে অন্যরা ভালো করবে। শেয়ারবাজারের গভীরতা বাড়ানোর জন্য সরকারি শেয়ারগুলো ছেড়ে দেওয়া উচিত। আর কিছু মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি রয়েছে যারা বাইরের দেশগুলোতে তালিকাভুক্ত। পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ইন্ডিয়াতে তালিকাভুক্ত হলেও আমাদের দেশে তালিকাভুক্ত না।
আমাদের দেশের যে ব্যাংকটি সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করছে তাদের নিট প্রফিট ১ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি একটি ব্যাংকের কয়েকটি শাখা দিয়ে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রফিট করছে। এসব বিদেশি ব্যাংক কোনো কোনো দেশে লোকাল সাবসিডিয়ারি হয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এখানেও তারা ব্রাঞ্চ কোম্পানি খুলে অনে আয় করতেছে। শুধু এলসির গ্যারান্টার থেকেই বিদেশি ব্যাংকগুলো টাকা পাচ্ছে।
সাংবাদিক: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কমিশনের কি ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে পারলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। আর ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে উদ্যোগ নিতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। আগে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে প্রণোদনা দেওয়া হতো। গত ১৫ বছরে সেগুলো তুলে দেয়া হয়েছে। এখনও যদি ভালো কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য কোনো ইনসেন্টিভ দেওয়া হয় সেটা খারাপ না।
ইউনিলিভারের কয়েক হাজার কোটি টাকা টার্নওভার, হাজার কোটি টাকা প্রফিট করে। আবার পুরো মালিকানায় তারা নিজেরা। এভাবে যেসব মাল্টিন্যাশনাল ও বিদেশি কোম্পানিগুলো ব্যবসা করছে সেসব কোম্পানিতে এদেশের জনগনকে মালিকানা দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে ১০ শতাংশ শেয়ার অফলোড করতে পারলে তালিকাভুক্ত হতে পারে।