ফিলিস্তিনিদের গাজা ছাড়ার নির্দেশ– ইসরাইলের গণহত্যা আড়াল করার অজুহাত মাত্র

গাজা

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে যখন হামাস আক্রমণ করে, সেদিন থেকেই গাজায় প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ শুরু হয়েছে। টানা পাঁচদিন অকল্পনীয় মাত্রায় বোমাবর্ষণের পর ১২ তারিখে এসে গাজা উপত্যকার উত্তর অংশে বসবাসকারী ১১ লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ইসরায়েল। উত্তরাংশের মধ্যে উপত্যকার সবচেয়ে জনবহুল গাজা সিটিও পড়ে। ইসরায়েল ২৪ ঘণ্টা এই সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, জানায়– আসন্ন স্থল আক্রমণ থেকে বাঁচতে যারা পালাবে, তাদের জন্য এ সময়টা সড়কগুলো নিরাপদ (হামলামুক্ত) রাখা হবে। সঙ্গেসঙ্গেই অনেক পরিবার পায়ে হেঁটে দক্ষিণ দিকে রওনা দেয়, অনেকে গাদাগাদি করে ট্রাকে চেপে বসে, আর ব্যক্তিগত গাড়ি থাকা মুষ্টিমেয় কিছু ‘সৌভাগ্যবান’ পরিবারও স্বর্বস্ব নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে।

অথচ গত কয়েকদিন ধরে উত্তরাঞ্চলের সড়কগুলোয় বোমা ফেলছে ইসরায়েল। ফলে বেসামরিক মানুষের পলায়ন চেষ্টা হয়ে পড়েছে দুঃসাধ্য ও ধীরগতির। তার চেয়েও ভরাবহ ঘটনা হলো– ইসরায়েল তার প্রতিশ্রুতি ভেঙে দক্ষিণমুখো যানবাহন ও মানুষের ওপর হামলা করছে, এমন সংবাদ জানা যাচ্ছে।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ১৩ অক্টোবর দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার সময় ইসরায়েলি এক হামলায় ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ঘটনা ঘটেছে জনবহুল গাজার সালাহ আল-দ্বীন সড়কে। অথচ এই সড়কটিকে ‘নিরাপদ’ ঘোষণা করেছিল ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।

এসব হামলার মধ্যেই শেষপর্যন্ত অনেকেই পালাতে পেরেছে। কিন্তু, আরও বহুজন কিন্তু একারণে বাধাগ্রস্ত হয়ে সেটা করতে পারেনি। বা ভয়ে ফিরে গেছে। একথা মাথায় রাখতে হবে, জ্বালানির অভাবে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো পালাচ্ছিল পায়ে হেঁটে। তাদের সাথে ছিল নারী, শিশু ও বয়স্করা। পথশ্রমে, খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে, শারীরিক অক্ষমতায় তাদের পালানোর চেষ্টাই ছিল প্রাণান্তকর, বিশেষত যখন চারধারে হামলা হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় পড়েছিল বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেওয়া ভবনগুলোর ধবংসাবশেষ। এরমধ্যে তাদের পথ চলতে হয়েছে। তারমধ্যে ইসরায়েলিরা তাদের ওপর আক্রমণ করেছে। পলায়মান মানুষের মধ্যে আহতরাও ছিল। ফলে শেষপর্যন্ত কতজন তথাকথিত নিরাপদ দক্ষিণ অংশে যেতে পেরেছে, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

এছাড়া, গাজার হাসপাতালগুলো গুরুতর রোগী দিয়ে পূর্ণ, অনেক রোগীকেই সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এসব অসহায় মানুষকে ছেড়ে না যাওয়ার অকুতোভয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বেশিরভাগ হাসপাতালের চিকিৎসক, স্বাস্থ্য সেবাকর্মীরা।

একবার বাসভূমি ছাড়লে, চিরতরে নির্বাসিত হতে হবে, অর্থাৎ ইসরায়েলি দখলে চলে যাবে, এমন আশঙ্কা থেকেও অনেকে যাননি। ভালোমন্দ যাই ঘটুক, শেষনিঃশ্বাস তারা নিতে চান, রক্তের শেষবিন্দুতে তারা সিক্ত করতে চান জন্মস্থল।

১৯৪৮ সনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালে ফিলিস্তিনিরা যে মহাবিপর্যয় বা নাকবা’র শিকার হয়েছিলেন, পিতৃপুরুষের সেই দুঃসহ স্মৃতি তাই আবারো স্মরণ করছেন এ প্রজন্মের ফিলিস্তিনিরা। সেবার তাদের পূর্বপুরুষদের বসতভিটা, কৃষিজমি, ব্যবসা সবকিছু ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হয়েছিল গণহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণের মধ্যে দিয়ে। তারপর সেই জমিনে দিনে দিনে পশ্চিমাদের নগ্ন সমর্থনে আরও থাবা গেড়ে বসেছে শ্বেতাঙ্গ ইহুদি বসতিস্থাপনকারীরা। মুছে ফেলা হয়েছে ফিলিস্তিনি অনেক শহর, গ্রাম ও জনপদের নাম। ধবংস করা হয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আজো সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে পশ্চিম তীরে। এবার গাজাতেও কী তাই ঘটছে? ফিলিস্তিনিদের মনে এই সন্দেহ জাগাকে কী এরপরও অমূলক বলা যায়?

নাকবা’য় যারা বাস্তুচ্যুত হন, তাদের অনেকেই গাজায় আশ্রয় নেন। অর্থাৎ, তাদেরই বংশধর আজকের সিংহভাগ গাজাবাসী।

ফিলিস্তিনিদের এই অনুভূতি ভালোভাবেই জানে ইসরায়েলি সরকার। তারা এটাও জানে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার নোটিশে গাজার মতো জনবহুল, দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলের ১১ লাখ বাসিন্দার সরে যাওয়া, পরিবহন ও অবকাঠামো দিক থেকেও অসম্ভব।

তারপরও সরে যাওয়ার এই নির্দেশনা কেন? আসলে এর মাধ্যমে তারা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করেছে – এই সতর্কবাণী দেওয়ার ঘটনা ইসরায়েলি সরকারের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞগুলোকে আড়ালে রাখতে সহায়তা করবে। বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা প্রসঙ্গে তেল আবিব তখন তাদের যুগ যুগ ধরে চালিয়ে আসা মিথ্যাচার পুনরাবৃত্তি করে বলবে, নিহতদের হামাস মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। এর মধ্যেই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা কথিত এই মানবঢালের কথা বলছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তার সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় কাতারে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, হামাসের এই মানবঢালের কারণেই নাকি ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে বেসামরিক প্রাণহানি এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ছে। বলাবাহুল্য, নির্জলা মিথ্যার চেয়েও বড় কিছু বলেছেন তিনি।

এদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও ত্রাণ সংস্থাগুলো স্পষ্ট করে বলেছে, কেবল সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের আওতায় ইসরায়েলের সরকারের যেসব দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে, সেখান থেকে দায়মুক্তি পাবে না তারা। এই নির্দেশনা বাতিল করতেও তারা ইসরায়েলি সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

গাজাবাসীকে সরে যাওয়ার নির্দেশনা বা গাজা নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে জাতিগত শুদ্ধঅভিযান (গণহত্যার)-ই প্রথম পদক্ষেপ– সেবিষয়ে তেমন কোনো রাখঢাকের চেষ্টা কিন্তু ইসরায়েলের সরকারের নেই। তেল আবিবের কোনো দোষই পশ্চিমা সরকার বা গণমাধ্যমের একচোখা দৃষ্টিতে পড়ে না। অথচ বিভিন্ন ইসরায়েলি মন্ত্রী ও রাজনিতিবিদ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজাকে বিলীন করে দেওয়ার কথা বলছেন। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অমানবিক সম্বোধন ব্যবহার করছেন। তাদের কথাবার্তা অনুসারে, ফিলিস্তিনিরা মানুষই নয়। যার হাতে সামরিক অভিযানের দায়িত্ব, ইসরায়েলের সেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী গাজার ফিলিস্তিনিদের ‘মানব পশু’ বলে উল্লেখ করেছেন।

এদিকে গাজা ও মিশরের সিনাই উপদ্বীপের মধ্যেকার রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং খুলে দিতে মিশরকে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বিচার বোমাবর্ষণ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া এই মুহূর্তে খুবই জরুরি, সেদিক দিয়ে এ পদক্ষেপ হয়তো সঠিক, কিন্তু আমি মনে করি, রাফাহ ক্রসিং দিয়ে যেসব ফিলিস্তিনি গাজা ছাড়তে পারবে, হয়তো তারা আর কোনদিনই সেখানে ফিরতে পারবে না। এই ভয় অমূলক নয়, ফিলিস্তিনের নিজ ইতিহাসই তার প্রমাণ।

ফিলিস্তিনের ইতিহাসে বারবার একই কাজ করেছে ইসরায়েলের সরকার। শরণার্থীদের ফিরে আসার অধিকার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হাজারো অনুরোধ, আহ্বান তারা থোরাই কেয়ার করেছে। বসতভূমিতে তাদের ফেরার অধিকারকে ইসরায়েল স্বীকারই করে না।

বিভিন্ন সংস্থার হিসাবমতে, বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ ফিলিস্তিনি স্থায়ীভাবে নির্বাসিত রয়েছে, এবং নির্বাসিত বা তাদের বংশধরদের জন্মভূমিতে ফিরতে দেওয়া হয়নি কোনদিন।

এই অবস্থায়, উত্তর গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের ওপর এক অসম্ভব সিদ্ধান্ত – ঘরে থেকে মরবে, না জন্মের মতো জন্মভূমিকে বিদায় জানাবে– তা নেওয়ার ভার চাপানো হয়েছে। ওদিকে প্রকাশ্যে স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে ইসরায়েল সরকার। গাজার সীমান্ত বেড়ার কাছে সমবেত করা হয়েছে শত শত ট্যাংক, কামান, সাঁজোয়া যান।

এরমধ্যে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে মিথ্যাচার ও অপব্যাখ্যার বেসাতি খুলে বসেছেন ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ ও সমরনায়কেরা। ইসরায়েলি সেনাদের মনোবল বাড়াতে ১৯৪৮ সনে দেইর ইয়াসিন গণহত্যায় অংশ নেওয়া এক ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধীকেও হাজির করেছেন তারা। বয়োবৃদ্ধ এই যুদ্ধাপরাধী (ইসরায়েলিদের চোখে জাতীয় বীর) সেনাদের উদ্দেশ্য বলেন, ‘তাদের স্মৃতিচিহ্নও মুছে দাও… তাদের, তাদের পরিবারকে, নারী ও শিশুদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করো। এই পশুদের আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।’

এই সমস্ত ঘটনা আমাদের বলছে, স্থল অভিযান হবে অত্যন্ত নিষ্ঠুর। ‘হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বকে সমূলে উৎখাত’ এর দোহাই দিয়ে এক গণহত্যার পথ প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইসরায়েলি সরকার, পশ্চিমা বিশ্ব ও আরব বিশ্বে তাদের অনুগত নেতারা তেল আবিবকে আরও একবার বিনাবাধায় আরেকটি গণহত্যার সুযোগ করে দিচ্ছে। এই অভিযানের মধ্যে দিয়ে উত্তর গাজা প্রথমে ফিলিস্তিনি শূন্য ও তারপর দখল করবে ইসরায়েল। আর দক্ষিণ গাজায় পালিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের আরও ছোট্ট কারাগারে আটকে ফেলবে। এই হলো আজকের দুনিয়ায় তথাকথিত আন্তর্জাতিক নিয়ম ও মানবাধিকারের নমুনা, যার গৌরব প্রচারে কতই না সরব পশ্চিমা দুনিয়ার নেতারা। যেভাবেই দেখুন না কেন, গাজায় ইসরায়েলি অভিযানকে স্রেফ জাতিগত শুদ্ধি অভিযানই বলতে হবে, এবং তা ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া নাকবার’ই চলমান ধারা।

শেয়ার করুন:-

বিজ্ঞাপন

সম্পর্কিত খবর