পুঁজিবাজার সংস্কারে প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিনিয়োগকারীদের ২৫ দাবি

পুঁজিবাজারের সংস্কারের জন্য ২৫ দফা দাবি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি পাঠিয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে মুশফিকুর রহমান রনি এবং প্রকৌশলী খোরশেদ আলম মিঠু এ প্রস্তাবনা প্রেরণ করেন। প্রস্তাবনার অনুলিপি অর্থ উপদেষ্টা ; বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর; বিএসইসি, এনবিআর, এফআরসি, ডিএসই, সিএসই, আইসিবি ও পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যানের কাছেও পাঠানো হয়। মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে পুঁজিবাজার সংস্কারের ২৫ দফা দাবি তুলে বলা হয়, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধনের অনুপাত উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে নিম্নতম। যা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা, এবং বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো যেমন ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, এবং ফিলিপাইনের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। ১৯৯০-এর দশক থেকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে এক প্রকার জুয়ার আসরে পরিণত করেছে। তখন থেকেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া প্রায় ৯৭ শতাংশ কোম্পানি মূলত অস্থিতিশীল ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য বাজারে প্রবেশ করেছে। এই কোম্পানিগুলো ব্যাপক প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন বিএসইসি নেতৃত্ব, নির্বাহী পরিচালক, ইস্যু ম্যানেজার, ডিএসই বোর্ড সদস্য, অডিট ফার্ম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানো।

চিঠিতে বলা হয়, তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোম্পানিগুলো শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে নিজেদের সর্বোচ্চ লাভ নিশ্চিত করে এবং অতিরিক্ত মূল্যযুক্ত শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মূল্যহীন শেয়ার নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অথচ অপরাধীরা বিনা শাস্তিতে পার পেয়ে যায়। এই শোষণমূলক প্রক্রিয়াটি বারবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, যা পুঁজিবাজারের প্রতি জনসাধারণের আস্থাকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

চিঠিতে বিনিয়োগকারীরা জানান, যারা বছরের পর বছর ধরে পুঁজিবাজার ধ্বংসের সাথে জড়িত, তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। একইসঙ্গে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে পুঁজিবাজারের জন্য জরুরি এবং ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছি। পুঁজিবাজারকে জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গতিশীল ইঞ্জিনে রূপান্তর করতে হবে, যা অর্থনীতির স্বার্থ এবং প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের আকাঙ্ক্ষা উভয়ই পূরণ করবে।

এছাড়া চিঠিতে ২৫ দফা সংস্কারের দাবি জানান বিনিয়োগকারীরা। এসব দাবিকে আবার তিন ভাগেও রূপান্তর করেন তারা। প্রথম ধাপে এক মাস, দ্বিতীয় ধাপে ছয় মাস এবং তৃতীয় ধাপে ১২ মাসের মধ্যে সংস্কার সম্পন্নের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।

প্রথম ধাপে তালিকাভুক্তির মানদণ্ড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, শেয়ারের শ্রেণিবিন্যাস পুনর্বিবেচনা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ উৎসাহিত করা, ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স বাতিল, নেতিবাচক ইক্যুইটি সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানো, কর প্রণোদনার মাধ্যমে তালিকাভুক্তি উৎসাহিত করা, নীতিমালা সহজীকরণের জন্য একটি পলিসি কমিটি গঠন, ইস্যু ম্যানেজারদের প্যানেল গঠন, আইপিও অনুমোদনের জন্য জনসম্মুখে পর্যালোচনা বাধ্যতামূলক করা এবং ফ্লোর প্রাইস সময়কালের জন্য সুদ প্রদান নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। এসব সংস্কার এক মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে বিনিয়োগকারীরা।

দ্বিতীয় ধাপে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বিশেষ ফরেনসিক অডিট, খুচরা বিনিয়োগকারীদের ঋণ বাতিল এবং ঋণসুবিধা সংস্কার, শেয়ার পুনঃক্রয়ের জন্য সংশোধিত নীতিমালা, বোর্ড পরিচালনা ও স্বাধীনতা বাড়ানো, মিউচুয়াল ফান্ড নিয়মাবলী শক্তিশালী করা, ফান্ড ম্যানেজারদের মাধ্যমে খুচরা বিনিয়োগ উৎসাহিত করা, অংশগ্রহণকারীদের ১০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডিং সীমা বাতিল করা, পরিচালনা পর্ষদ এবং অডিটরদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মাধ্যমে ডেটা কারসাজি প্রতিরোধ এবং পেশাদার হিসাববিদদের মাধ্যমে অডিট তত্ত্বাবধান শক্তিশালী করার দাবি জানানো হয়। দ্বিতীয় ধাপের সংস্কারের জন্য ৬ মাস সময় নির্ধারণ করা হয়।

তৃতীয় ধাপে ৫টি সংস্কারের দাবি জানায় তারা। বিনিয়োগকারীরা এসব সংস্কারের জন্য চিঠিতে এক বছর সময় বেঁধে দিয়েছে। এসব দাবিগুলো হলো- উদ্যোক্তা ও পরিচালক হোল্ডিংয়ের ন্যূনতম সীমা বাড়ানো, লাভজনক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আকৃষ্ট করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন প্রক্রিয়া মূল্যায়ন ও সংস্কার করা।

২৫ দফা দাবি জানানোর পাশাপাশি একটি যৌথ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছেন বিনিয়োগকারীরা। যেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি বিএসইসি কর্মকর্তাদের রাখা হবে। এতে বাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পাশাপাশি সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি জনসাধারণের আস্থা আরও শক্তিশালী হবে আশা করছে বিনিয়োগকারীরা।

শেয়ার করুন:-

বিজ্ঞাপন

সম্পর্কিত খবর