পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেছেন, আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেট নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে আন্তর্জাতিক। সেসব সমস্যা অভ্যন্তরীণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাইরের বিভিন্ন সমস্যা আমাদের উপর এসে পরেছে। কিন্তু নির্বাচন পরর্তী সময়ে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কারণ মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন হবে। পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ব্যবসায়ী, ব্যাংক এবং অন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। আর বিদেশিদের বিনিয়োগ নির্বাচনের পর আসা শুরু হবে।
এসময় তিনি বলেন, ক্যাপিটাল মার্কেট বলতে সবাই সেকেন্ডারি মার্কেটকেই মনে করেন। অথচ পুঁজিবাজারে অনেক ধরণের প্রোডাক্ট রয়েছে। যেমন গত একবছরে বন্ড মার্কেট সাংঘাতিকভাবে উন্নতি হয়েছে। ট্রেজারি বন্ড, ট্রেজারি বিল ইতিমধ্যেই চলে এসেছে, ট্রেড শরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন রকমের সুকুক এবং অনান্য বন্ড আমারা নিয়ে আসছি। সামনে অরেঞ্জ বন্ড, পিংক বন্ড আসবে। ডেরিভেটিবস নিয়ে কাজ হচ্ছে এবং আসা শুরু হয়ে গেছে। সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল) একটিভ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চলে আসবে।
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের কাছে সেকেন্ডারি মার্কেট ক্যাপিটাল মার্কেট না, আমাদের আগের কমিশনগুলো সেকেন্ডারি মার্কেটকে ক্যাপিটাল মার্কেট মনে করতো। ক্যাপিটাল মার্কেটের সব অঙ্গগুলোই ছিলো না। আপনারা সেকেন্ডারি মার্কেটকে ভাবতেন ক্যাপিটাল মার্কেট, এটা ভুল ধারণা। আমাদের পূর্ববর্তী যারা ছিলেন কেউ কেউ পত্রিকাতে শুনি আমাদের সমোচলনা করে। ওনারা যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন ক্যাপিটাল মার্কেটের উপাদান নিয়েও চিন্তা করেনি। ওনারা কেন করেননি সেটা আমার প্রশ্ন। যেই উপাদানগুলো অনুপস্থিত ছিলো, সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। সেগুলো যদি বিশ বছর আগে আসতো আজকে বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেটের চেহারা সম্পূর্ণ আলাদা থাকতো। আমরা এখন কাজ করছি, রেজাল্ট হয়তো দু-চার-পাঁচ বছর পর আপনারা পাবেন। আমরা করোনা যুদ্ধ সবকিছুর মধ্যে ক্যাপিটাল মার্কেটের মিসিং উপাদানগুলো নিয়ে আসছি। এখন সেগুলো আসতে আসতে বড় হয়ে ঠিক হওয়ার পর আপনারা একটা সঠিক ক্যাপিটাল মার্কেট পাবেন। আর যেটা সেকেন্ডারি মার্কেট সেটা আন্তর্জাতিক কারণে ফ্লোর প্রাইসের মতো বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে হয়েছে। পুঁজিবাজারের পুঁজি চলে যাওয়ার কারণে আমাদের সরকারের বার বার বদনাম হয়। এটার কারণ কখনো সরকার না, এটার কারণ কিছু গ্রুপ, কিছু ব্যক্তি। যারা ৮০ শতাংশ রিটেইলার যে মার্কেটে তাদের কথা চিন্তা না করে বিভিন্ন এ্যাকশন নেয়। আর আমরা যেটা করছি তাতে সমালোচনা হয়, হোক। আমরা আগে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি নিরাপত্তা দিচ্ছি। কারণ তারা ৮০ শতাংশ এই মার্কেটের। অথচ যেই মার্কেটে ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টর ৮০ শতাংশ তাদের সাথে আমাদের তুলনা করা হচ্ছে। তাদের মতো সিদ্ধান্ত নিলে আজকে আমাদের দেশের মানুষ নিঃস্ব হয়ে চলে যাবে।
‘আমরা যেভাবে কাজ করছি তাতে মার্কেটের ক্যারেক্টার পরিবর্তন হলে আস্তে আস্তে ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টর বাড়বে। যেভাবে আমরা লাইসেন্স দিচ্ছি, অনুমোদন দিচ্ছি, বড় বড় গ্রুপগুলোকে বাজারে নিয়ে আসছি। এটা হয়ে গেলে তখন আমরা বিদেশের সাথে অনেক কিছু একসাথে রাখতে পারবো। ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশের বড় বড় ইনভেস্টর আসা শুরু হয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করে পুঁজি নষ্ট হওয়ার সুযোগ আমরা কখনো হতে দেবো না। পুঁজিকে নিরাপদ করে তারপর লাভ-লোকসান যা হওয়ার হবে। ’
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের সমন্বিত শেয়ার ধারণ পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগেতো এসব নিয়ে কেউ খেয়াল করেনি। এখন এই দিকে খেয়াল করে এটার সংখ্যা ১৩-১৪ টায় নিয়ে আসছি। এই কোম্পানিগুলো যারা ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারন করতে এখনো ব্যথ হয়েছে, এর মধ্যে ৭-৮টা কোম্পানির অবস্থা বেশি দুর্বল। আর যেগুলো আছে তাদেরকে আমরা খুব চাপে রেখেছি। যেভাবে ঠিক করার কথা ছিলো আর্থিক অবস্থার কারণে সেটা তারা পারছে না। সেটার জন্য বোর্ডে হাত দিলে সেটা নিয়েও সমলোচনা হবে। তাদেরকে সময় দিয়েছি কিন্তু চাপে রেখেছি, তাদের কিন্তু ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারন করতেই হবে।
বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, অনেক ভালো বড় বড় কোম্পানি ছিলো যারা এখন রাইট বোনাস শেয়ার নিয়ে আসছে। তাদেরও কিন্তু ফ্লোটিং কম ছিলো। তাদেরও কিন্তু ১০ শতাংশ বাজারে ছিলো না। সেসব কোম্পানিগুলো এখন রাইট বোনাস নিয়ে আসছে আইনকে প্রতিপালন করার জন্য। বড় বড় কোম্পানির ফ্লোটিং না থাকার কারণে একটা শেয়ারের দাম হাজার হাজার টাকা হয়ে আছে। কেন হবে এরকম? কারণ ফ্লোটিং নাই। এসব কোম্পানির শেয়ার বাজারের মানুষের কাছে তেমন নেই, সব কোম্পানি বা তাদের নিজস্ব লোকজনের কাছে। এগুলো সব এখন ঠিক করা হচ্ছে।
আমরা সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি জানিয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের স্থির অবস্থা বা পিছন দিকে পাবেন না। আগাতে গিয়ে আমাদের বাস্তবতাকেও গুরুত্ব দিতে হয়। অর্থনৈতিক অবস্থা সবারই ভালো না। ব্যবসা-বাণিজ্য সবারই ভালো যায় না। এগুলোও বিবেচনা করতে হয়। মানুষকে শাস্তি দিলেই হবে না বাস্তবতা বুঝতে হবে, মানুষের উপর অশান্তি তৈরি করে কখনো ভালো কিছু হবে না।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে গঠিত (এসএমই) মার্কেটে অনেক কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩০ থেকে ৪৫ কোটি টাকা কিন্তু মূল মার্কেটে দেড় বা দুই কোটি টাকা পেইডআপ, সেসব কোম্পানি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরকম কোম্পানির সংখ্যা এখন কমে গেছে। এটা ৫০টিরও বেশি ছিলো। এখন সম্ভবত এর সংখ্যা ১২ বা ১৩টা। তার মধ্যে ৬-৭ টা তো নাই। যেগুলো আছে সেগুলো এখন ঠিক করা হচ্ছে।
সরকারি কোম্পানিগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোর বোর্ড এবং গভর্নিং বডি তারা আমাদের কর্পোরেট গভর্নেন্স রেগুলেটরি এজিএমের মধ্যে আসতে নিরুৎসাহিত। ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আসতো সরকারের রাজস্ব খাতে অনেক সুবিধা হতো এবং সরকার তার ইক্যুইটি বা ইনভেস্টমেন্ট ফেরৎ পেয়ে শক্তিশালী হয়ে যেতো। কোম্পানিগুলো উৎসাহ না থাকার পিছনে কারণ তাদের বোর্ডগুলো। কোনো রকম গভর্নেন্সের আওতায় তারা ইচ্ছা করে আসতে চায় না। এর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে গভর্নেন্সে সমস্যা আছে এবং লস করছে। আমার মনে হয় তাদের মধ্যে ভালো কোনো বোর্ড আসবে। তারা তখন তাদের ভালোর জন্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে আন্তর্জাতিক মানে যাওয়ার জন্য কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড ফলো করে সব মেনে চলবে।
পুঁজিবাজার নিয়ে মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ালে আপনাদের পদক্ষেপ কি জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, গুজব বা সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কারণে অনেক লোক গ্রেফতার হয়েছে এবং জেলেও গেছে। যারা গুজব ছাড়ায় তাদের বিরুদ্ধে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেটা আমরা পাবলিকলি প্রকাশ করি না। ফলে অনেকে না জেনে গুজবে লিপ্ত হয়ে নিজের এবং পারিবারিক জীবনে অশান্তি ভোগ করছেন।